সকালের রোদের চিকচিকে আলো চোখে পড়ে ঘুম ভাঙ্গে ডাঃ আজমলের। পূবদিকের জানালা দিয়ে সকালের প্রথম আলো সরাসরি তার বিছানাতেই পড়ে। ফেব্রুয়ারি মাসের সকালের এই রোদটা বেশ লাগে আজমল সাহেবের। ধানমন্ডীর এই বাড়ীটিতে একাই থাকেন তিনি। স্ত্রী গত হয়েছেন বেশ ক’বছর আগে, ছেলেমেয়েরা কেউই বাংলাদেশে বসবাস করেনা। ঢাকা মেডিকেল কলেজে দীর্ঘকাল এনাটমির শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে বছর ছয়েক হল অবসর নিয়েছেন। আড়মোড়া ভেঙ্গে পাশ ফিরতে গিয়েও উঠে পড়লেন আজমল সাহেব। অন্যদিন হলে হয়ত আরো ঘন্টাখানেক এপাশ ওপাশ করে তবে উঠতেন। অবসর গ্রহনের পর থেকে তাই হয়ে আসছে। হঠাৎই তার মনে পড়ে গেল আজ তার কলজে যেতে হবে। বিছানায় বসেই পাশের টেবিলে রাখা বেল টিপলেন। প্রায় সাথে সাথেই পাশের ঘর থেকে তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে এল সাত্তার। সে আজমল সাহেবের ফুট ফরফমাশ খাটে, বাজার করে আর এ বাড়িতে থাকে। তাকে বিছানা গুছিয়ে কফি দিতে বলে আজমল সাহেব বাথরুমে গেলেন হাতমুখ ধোয়ার জন্য। আজ দাড়ি কামাতে হবে। প্রয়োজন না হলে উনি সাধারনত দাড়ি কামান না। খোঁচা খোঁচা দাড়ি প্রায় সবসময়ই তার গালে শোভা পায়। হাতমুখ ধুয়ে দাড়ি কামানোর জন্য আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষ্ণণের জন্য যেন থমকে গেলেন। হঠাৎ করেই নিজের বয়সের দিকে চোখ পড়ে তার। আয়নাতে প্রতিবিম্বের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে রইলেন কিছুক্ষন। প্রতিবিম্বটি যেন বলে উঠল, ‘বুড়িয়ে গেছ হে ডাক্তার আজমল আকবর; চুলের রঙ শণের মত, ভ্রুগুলোও পেকে গেছে। অভিজ্ঞতায় একেবারে বটবৃক্ষ হয়ে উঠেছ। দেখতো, ষাট বছর আগের আজমলের সাথে আজকের আজমলকে মেলাতে পার কিনা? প্রতিবিম্বটি যেন ধীরে ধীরে একটি আঠারো বছরের ছেলেতে পরিণত হলো। ছেলেটিকে চিনতে কিছুটা বেগ পেতে হল আজমল সাহেবের। মুহুর্ত পরে তিনি আবিষ্কার করলেন এটি তারই আঠারো বছর বয়সের চেহারা। চমকে বেরিয়ে এলেন তিনি বাথরুম থেকে। আজ আর দাড়ি কামান হল না। গালভরা দাড়ি নিয়েই আজ কলেজে যেতে হবে। এর মাঝে সাত্তার বিছানা পরিষ্কার করে কফি রেখে চলে গেছে নাস্তা তৈরি করতে। ধূমায়িত কফির কাপে চুমুক দিয়ে খবরের কাগজ খুলে বসলেন।কফি শেষ হতে হতে নাস্তা চলে এল।
“তুমি নাস্তা করেছ সাত্তার?” আজমল সাহেবের প্রশ্ন।
“জ্বী স্যার”, সাত্তারের সংক্ষিপ্ত উত্তর।
নাস্তা শেষ করে ঘড়িতে চোখ ফেরালেন আজমল সাহেব। এগারোটা বাজে। কিছুক্ষ্ণণের মধ্যেই বেরিয়ে পড়তে হবে। আজ একুশে ফেব্রুয়ারি, রাস্তায় যানযট থাকতে পারে। কোথাও দেরি করে যাওয়া তিনি পছন্দ করেন না। ড্রাইভার ইলিয়াসকে গাড়ী বের করতে বলে তৈরি হয়ে নীচে নেমে এলেন।
- ভাল আছ ইলিয়াস? তোমার ছেলেটার জ্বর সেরেছে?
- জ্বী স্যার। আইজ একটু ভাল, আপনের ছাত্র মনে হয় ভালই ওষুধ দিছে। তয় আপনে একটু দেখলে মনে হয় ভাল হইত।
- আমি তো এখন আর ভাল দেখতে পাইনা, বয়স হয়েছে। ওষুধের নামও সব মনে থাকেনা। ভুল হলে হিতে বিপরীত হবে। তুমি বরং রায়হানকেই দেখাও, ও তোমার ছেলের ভালই যত্ন নেবে।
- জ্বী স্যার
- চলো, আজ একটু কলেজে যাব।
আজমল সাহেব গাড়ীতে উঠে বসলেন। গাড়ী চলতে চলতে ইলিয়াস জিজ্ঞাসা করে, “স্যার, এতদিন পরে কলেজে যাইবেন, আবার পড়াইবেন নাকি?
- না, আজ অডিটোরিয়ামে স্মরণসভা আছে একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে, সবাই যেতে বলল তাই যাচ্ছি।
ঢাকা মেডিকেল কলেজে বেশ আজ সকাল থেকেই বেশ গুরুগম্ভীর কর্মব্যস্ত পরিবেশ। একুশে ফেব্রুয়ারিতে কলেজের শেষ বর্ষের ছাত্রছাত্রীরা অডিটোরিয়ামে স্মরণসভার আয়োজান করেছে। ডাঃ আজমল আকবরকে এখানে আমন্ত্রন করা হয়েছে স্মৃতিচারনের জন্য। আজমল সাহেব গাড়ী থেকে নেমে হেটেই ভেতরে গেলেন। হেটে যেতে যেতে তিনি বহুদিনের পুরনো স্মৃতির পাতাগুলো উল্টাচ্ছিলেন। এমন সময় তার একজন ছাত্র, ডাঃ রায়হান আসিফ দৌড়ে এসে তাকে স্বাগত জানায়। রায়হানকে সাথে নিয়ে তিনি তার সেই পুরোন ডিউটি কেবিনটিতে এলেন। সামনে দেখতে পেলেন ডাঃ চিত্রগুপ্তের নেইমপ্লেট। চিত্রগুপ্ত সাহা মেধাবী ছাত্র ছিল। এখন সে ভাল ডাক্তার এবং শিক্ষক। ডাঃ আজমল চেয়ার টেবিলগুলোতে এমনভাবে হাত বুলোতে লাগলেন যেন এগুলো তার একান্ত আপন। এমনি সময়ে চিত্রগুপ্ত তার কেবিনে প্রবেশ করে চমকে উঠল,
- আদাব স্যার। আপনি এখানে, আর আপনাকে সমস্ত ক্যাম্পাস খুঁজে বেড়াচ্ছি। প্রোগ্রাম তো অনেকক্ষণ শুরু হয়ে গেছে। চলুন প্লিজ।
আজমল সাহেব এগিয়ে অডিটোরিয়ামের দিকে, যখন স্টেজে উঠে এলেন তখন প্রিন্সিপাল সাহেব বক্তৃতা দিচ্ছিলেন। তিনি বলছিলেন বায়ান্নর সেই উত্তাল দিনগুলোর কথা, একুশে ফেব্রুয়ারির কথা- যেদিন ছাত্রদের সাথে সাধারন মানুষও রাজপাথে নেমে এসেছিল। ভাষার দাবীতে সোচ্চার হয়ে গলা মিলিয়ে শ্লোগান দিয়েছিল, “রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই”।বুকের রক্ত রাজপথে ঢেলে দিয়ে ছিনিয়ে এনেছিল আমাদের মাতৃভাষায় কথা বলার অধিকার।
আজমল সাহেব যেন হারিয়ে যাচ্ছিলেন সেই পুরনো দিনগুলিতে। সম্বিৎ ফিরে পেলেন প্রিন্সিপালের কন্ঠে মাইকে নিজের নাম শুনতে পেয়ে। তাকে সামনে এসে কিছু বলার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে। তিনি আসন ত্যাগ করে ডায়াসে এলেন,
“প্রিয় ছাত্রছাত্রীরা, আমি আজ তোমাদের সামনে এমন একটি অভিজ্ঞতার কথা বলব, যা আমি কোনোদিন প্রকাশ করিনি। বায়ান্ন সালে আমি ঢাকা কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র আর আমার বড় ভাই আশরাফ আকবর ঢাকা বিশ্ববিদ্যাল্যের রসায়ন বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। বেশ কিছু দিন থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বেশ উত্তপ্ত ছিল। আসলে চার বছর আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের কনভোকেশনে জিন্নাহ সাহেবের উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা ঘোষনা করার পর থেকেই তীব্র অসন্তোষ দানা বাঁধতে শুরু করে। শেখ মুজিব, এম এ ত্বোয়াহা আর অলি আহাদ তো একেবারে সাথে সাথেই সমাবেশের মধ্যে প্রতিবাদ করেছিলেন। এরপর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের আদলটাই যেন পালটে যায়। দিন মাস পার হয়ে বছর চলে যায়, পরিস্থিতি খারাপই হতে থাকে। ছাত্রদের দিকে তাকালে মনে হত তাদের চোখ দিয়ে যেন আগুন ঝরছে। দিনের পর দিন ধরে যেন এর প্রতিকারের জন্য তারা তৈরি হচ্ছিল। সরকার হয়ত এ আগুনের কিছুটা আঁছ অনুভব করতে পেরেছিল। তাই তারা আগে থেকে সমস্ত মিছিল মিটিং তো নিষিদ্ধ ঘোষনা করেই, কোথাও ৯/১০ জন এক জায়গাতে দাঁড়িয়ে কথাও বলতে পারত না। হঠাৎ ফেব্রুয়ারির ২১ তারিখে ১৪৪ ধারা জারি হল। আমি তখন হোস্টেলেই ছিলাম। আমার ঘরে বসেই শুনতে পেলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আর ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সাধারন জনতাও তাদের সাথে যোগ দিচ্ছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনে তারা জড়ো হচ্ছে। আমার রুমমেট মলয় বলছিল, “আশরাফ ভাই তো মহসীন হলে, ওনার একটু খোঁজ নিবি না?” কিন্তু ১৪৪ ধারার জন্য আমারা কেউই বাইরে যেতে ইতস্তত বোধ করছিলাম। এমনি সময়ে আমাদের সহপাঠি সিদ্দিক হাঁপাতে হাঁপাতে এসে বলল, ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনে মিছিলের উপর পুলিশ গুলি চালিয়েছে। অনেকে মারা গেছে। শোনামাত্র আমি ১৪৪ ধারা উপেক্ষা করেই উর্ধ্বশ্বাসে ছুটে যাই মহসীন হলে। কিন্তু গিয়ে তাকে আর পাইনি, সকালেই বেরিয়ে গেছেন টিএসসির উদ্দেশ্যে। সেখান থেকে আরো ছাত্রদের সাথে মিছিলে গিয়েছিলেন তিনি। তারপর তার আর কোনো খবর পাইনি। মিছিলে যারা শহীদ হয়েছিলেন তাদের নামের মাঝেও তার নাম শুনতে পাইনি। অনেকের নামই অবশ্য তালিকায় ছিলনা। পাকিস্তানিরা কাপুরুষের মত অনেক লাশ ট্রাকে উঠিয়ে নিয়ে গিয়ে গুম করে ফেলে। এর পাঁচ বছর পর আমি যখন ঢাকা মেডিকেল কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র, এনাটমির এসাইনমেন্টের জন্য স্কেলেটন নাড়াচাড়া করতে গিয়ে দেখতে পাই সেটির বুকের ডানদিকে একটি রিব (বুকের হাড়) কম। চকিতে আমার মনে পড়ল বড় ভাইয়ের বুকের ডানদিকে একটা হাড় জন্মগতভাবে কম থাকায় তাকে শীতের সময় বেশ সাবধানে থাকতে হত, ঠান্ডা বেশী পড়লে তার মৃদু শ্বাসকষ্ট হত। একমুহুর্তের জন্য মনে হল এটা হয়ত তারই স্কেলেটন। আমাদের ছেলেবেলায় গাছে চড়ার সময় গাছ থেকে পড়ে গিয়ে তার হাঁটুতে একটা ফ্র্যাকচার হয়েছিল। আমি হাঁটু পরীক্ষা করে দেখলাম, ডান পায়ের প্যটেলাতে (হাঁটুর হাড়) একটা ফাটা দাগ রয়েছে। অবশেষে দাঁত পরীক্ষা করে আমি স্কেলেটনটি চিনতে পারি। তোমরা এনাটমি ক্লাসে শিখেছ কিভাবে দাঁত থেকে পুরনো কংকাল সনাক্ত করা যায়। আমি চিত্রার্পিতের মত বড় ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকি। তার স্কেলেটনের পেলভিসের (কোমরের হাড়) বামদিকে একটা ফুটো। সেটা থেকে বুঝতে পারি তিনি কিডনীতে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান।”
আজমল আর খুব বেশি বলতে পারেন না। তার গলা ধরে আসে। ছাত্রছাত্রীদের ধন্যবাদ দিয়ে তিনি নেমে আসেন। যথাসময়ে সভে শেষ হয়। ডাঃ আজমল আকবর সবার সাথে বিদায় সম্ভাষন বিনিময় করে কলেজ থেকে বেরিয়ে এলেন। ইলিয়াস গাড়ীর দরজা খুলে দেয়, তিনি গাড়ীতে উঠে বসেন। তাকে দেখে মনে হয় যেন একদিনে তার বয়স দুই বছর বেড়ে গেছে।
বাড়ী ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। গাড়ী থেকে নামতে নামতে আজমল বললেন, “ইলিয়াস, আজ আর তোমার কোনো কাজ নেই, তুমি যেতে পার।” “জ্বী স্যার” বলে ইলিয়াস গাড়ীতে ঢুকে পড়ল। গাড়ী গ্যারেজে রেখে সে তার বাড়ী যাবে। আজমল সাহেব তার ঘরে এসে বসলেন। আজ তার বড় ক্লান্ত লাগছে। মনটাও ভারী হয়ে আছে। আজ হয়ত একটা স্লীপিং পিল লাগবে তার। এছাড়া ঘুম ভাল হবে না। নিজের ঘরের মধ্যেই দৃষ্টি ফেরালেন। বিছানা, পড়ার টেবিল, চেয়ার, ওয়ারড্রোব, বুকশেলফ। বুকশেলফের পর তার চোখ আটকে গেল। একদৃষ্টে চেয়ে রইলেন সেদিকে। এঘরে তার সাথে একটা স্কেলিটনও থাকে। স্কেলিটনটির বুকের ডানদিকে একটা রিব কম। পেলভিসের বামদিকে একটা ফুটো। ডান পায়ের প্যাটেলাতে ফাটা দাগ।
১৪ জানুয়ারী - ২০১২
গল্প/কবিতা:
৫ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪